নৌপথে মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্রমণ
মেঘময় এক পৃথিবীর ছবি মানেই বাংলার দার্জিলিং মেঘের রাজ্য সাজেক। যেখানে প্রতিনিয়ত প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। সাজেকে উপভোগ করা যায় নীল পাহাড়ের সারি, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সাদা মেঘের খেলা, আচমকা বৃষ্টি, মেঘের ছোঁয়া, মেঘের ভিতরেই হারিয়ে যাওয়া, সকালে ঘুম থেকে উঠে রিসোর্টের বারান্দা থেকে দেখবেন মেঘের সাগরের উপর দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। এ যেন পুরোপুরি একতি মেঘের উপত্যাকা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই সাজেকের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। সাজেকে আসার জন্য সবাই সড়ক পথে খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক আসেন। এই পর্বে আপনাদের জানাবো সাজেকে আসার ব্যাতীক্রমধর্মী আরো একটি পথ, যে পথে সাজেক এবং খাগড়াছড়ির সৌন্দর্য ছাড়াও উপভোগ করতে পারবেন কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য। নিতে পারবেন একটি অন্যরকম নৌ ভ্রমণের স্বাদ।
নদী পথে সাজেক আসবেন যেভাবে
ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি
রাজধানী ঢাকার সায়দাবাদ, গাবতলী, কমলাপুর, আরামবাগ, আবদুল্লাহপুর, কলাবাগান, ফকিরাপুল থেকে এসি, নন এসি সব ধরনের ভালো গাড়ি প্রতিরাতে রাঙ্গামাটির উদ্দ্যেশ্যে ছেড়ে আসে। ঢাকা টু রাঙ্গামাট রুটে চলাচল করা গাড়ির মধ্যে রয়েছে হানিফ পরিবহন, গ্রীন লাইন, এস আলম পরিবহন, শ্যামলী এন আর, শ্যামলী এস পি, রিলাক্স পরিবহন, ইউনিক পরিবহন, ডলফিন, সৌদিয়া ইত্যাদি। ঢাকা টু রাঙ্গামাটি রুটে নন এসি বাস ভাড়া ৮৫০-৯০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১২০০-১৭০০ টাকা। রাতের যেকোন গাড়িতে উঠলেই সকালে পৌঁছে যাবেন রূপের রাণী রাঙ্গামটিতে। জ্যাম না থাকলে এই রুটে সময় লাগে ০৭-০৮ ঘন্টা।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি
চট্টগ্রাম শহরের বি আর টি সি এবং অক্সিজেন মোড় থেকে রাঙ্গামাটি আসার জন্য গাড়ি পেয়ে যাবেন। সকাল ০৬টা থেকে রাঙ্গামাটি রুটের বাস চলাচল শুরু হয়। অক্সিজেন থেকে পাহাড়িকা ছাড়ে ভোর ০৬টা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি আসার ভালো বাস হচ্ছে পাহাড়িকা এবং বি আর টি সি। যারা ট্রেনে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসবেন রাঙ্গামাটি আসার উদ্যেশ্যে তাদের জন্য সুবিধা হবে, ষ্টেশন থেকে একটু সামনে আগালেই বি আর টি সি এর কাউন্টার। বি আর টি সি কাউন্টার থেকে টিকেট করে রাঙ্গামাটি চলে আসা। অথবা একটা সি এন জি নিয়ে অক্সিজেন মোড় চলে আসা। সি এন জি নাহলে ০৮নাম্বার বাসে করে চলে আসা। অক্সিজেন মোড়ে আসলেই পেয়ে যাবেন পাহাড়িকা বাসের কাউন্টার। চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি রুটে বাস ভাড়া ১৭০ টাকা। এইরুটে ভ্রমণ করার জন্য সঙ্গে অবশ্যই জাতীয় পরিচয় পত্র / এন আইডি কার্ড রাখবেন।
রাঙ্গামাটি থেকে নদী পথে সাজেক
সকাল সাড়ে ০৬টা থেকে শুরু হয় রাঙ্গামাটি থেকে লংগদুর লঞ্চ চলাচল। রাঙ্গামাটি শহরের ——– ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ে। বাস থেকে নেমেই নাস্তা করে লঞ্চে উঠে যাবেন। আবার চাইলে একরাত রাঙ্গামাটি শহরে থেকে রাঙ্গামাটির সকল পর্যটন কেন্দ্রো ঘুরে দেখতে পারেন। এবং পরদিন সকালের লঞ্চে চলে আসবেন লংগদু। লঞ্চে আসতে আসতে আপনি উপভোগ করতে পারবেন রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেকের অপরূপ সৌন্দর্য। এইখানে দেখবেন পাহাড়, জল, মেঘের এক অন্য রকম মিলবন্ধন। চলতি পথে ডুবে থাকা পাহাড়গুলোকে মনে হবে ছোট ছোট একেটা দ্বীপ। লেকের আশেপাশের মানুষদের জলকেন্দ্রিক জীবনযাপন আপনাকে মুগ্ধ করবে। সকাল সকাল লেকে এবং পাহাড়ি জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো পাখিদের কিচিরমিচির—এ আপনি হারিয়ে যাবেন। পথেই চোখে পড়বে শুভলং ঝর্ণা এবং বড়কল বাজার এবং রাঙ্গামটির অন্যতম সুন্দর একটি স্থান কাট্টলীর বিল। এত কিছু দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন লংগদু। লং গদু পৌছাতে পৌছাতে প্রায় ১১.০০-১১.৩০টা বেজে যাবে। কিন্ত আপনি যদি তাড়াতাড়ি আসতে চান সেক্ষেত্রে আপনাকে স্পিড বোট ভাড়া করে আসতে হবে। লঞ্চে আসলে আপনি সকাল ১০টার সাজেক যাওয়ার স্কট ধরতে পারবেন না। কিন্তু স্পিড বোটে আসলে হয়তো ধরতে পারবেন। এইরুটে লঞ্চভাড়া ———— জনপ্রতি
লংগদু থেকে সাজেক আসার জীপ গাড়ী পাওয়া যায়না। তাই আগে থেকেই খাগড়াছড়ি অথবা দিঘীনালা থেকে বুকিং দিয়ে রাখলে তারা আপনাদের লংগদু থেকে রিসিভ করে সাজেক নিয়ে আসবে। এইখান থেকে চাইলে আপনি গাড়ির হাফ প্যাকেজ এবং ফুলপ্যাকেজ নিতে পারবেন। হাফ প্যাকেজ হল লংগদু – সাজেক –খাগড়াছড়ি। আর ফুল প্যাকেজ হচ্ছে লংগদু –সাজেক – খাগড়াছড়ি- আলুটিলা –রিসাং ঝর্ণা – তারেং – ঝুলন্ত ব্রীজ। এইরুটের বর্তমান হাফ ভাড়া———-টাকা এবং ফুল ভাড়া———— টাকা লংগদু থেকে এইগাড়ি সাজেক আসার পথে আপনি পাবেন রোলার কোষ্টারের স্বাদ। উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা, স্থানীয় শিশুদের অভ্যর্থনা, এবং মেঘের খেলা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
যারা রাঙ্গামাটিতে একরাত থাকবেন তারা কোথায় কোথায় ঘুরবেন?
রাঙ্গামাটি শহরে বাস থেকে রিজার্ভ বাজার নেমে যেকোন একটা হোটেলে উঠে যাবেন। রিজার্ভ বাজারেই বেশ ভালো এবং বাজেট হোটেল রয়েছে। আপনি আপনার বাজেট মত যেকোন একটা হোটেলে উঠে যাবেন। ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে কাপ্তাই লেক ভ্রমণের উদ্যেশ্যে বের হয়ে যাবেন। কাপ্তাই লেক ঘুরার জন্য সবচাইতে ভালো বাহন হচ্ছে, টুরিষ্ট বোট। রিজার্ভ বাজারেই পেয়ে যাবেন টুরিষ্ট বোট। সারাদিনের জন্য বোট ভাড়া করে নিবেন। নৌকার মান এবং লোক সংখ্যা হিসেবে ভাড়া নির্ধারন হয়। কাপ্তাই লেকে দিয়ে প্রথমে চলে যাবেন বড়কল বৌদ্ধ মন্দির,তারপর শুভলং ঝর্ণা। বলে রাখা ভালো শুভলং এ দুইটি ঝর্ণা আছে। একটা বড় ঝর্ণা, আরেকটা ছোট। শুভলং ঝর্না দেখে চলে যাবেন বড়োকল বাজার। লেকের মধ্যেই আছে ভালো কিছু রেষ্টুরেন্ট। লেকের তাজা মাছ দিয়ে সেরে নিবেন দুপুরের খাবার। সেখান থেকে চলে যাবেন পলওয়েল পার্ক, ঝুলন্ত ব্রীজ ঘুরে সন্ধ্যায় চলে যাবেন হোটেলে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সাজেকের উদ্দ্যশ্যে রওন দিবেন।
রাঙ্গামাটিতে টুরিষ্ট বোট এবং হোটেল বুকিং এর জন্য যোগাযোগ করুনঃ +8801841862600
সাজেক আসার এসকর্ট এর সময়
প্রতিদিন সকাল ১০টায় এবং বিকেল ০৩টায় পর্যটদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্কট দিয়ে থাকে। স্কট দেয়া হয় বাঘাইহাট বাজার থেকে। এ বাজারের অবস্থান দিঘীনালা বাজার (বোয়ালখালী বাজার) থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। রাঙ্গামাটি থেকে ভোরে লঞ্চে রওনা দিয়ে সকাল ১০ টার স্কট পাওয়া যায়না। যারা এই রুটে সকালের স্কট ধরতে চান তারা চাইলে স্পিড বোটে করে রাঙ্গামাটি থেকে লংগদু আসতে পারেন। তাহলে হয়তো সকালের সাজেক ঢুকতে পারবেন। লঞ্চে যারা আসবেন তারা অবশ্যই চেষ্টা করবেন কোনভাবেই যেন বিকেলের স্কট মিস না হয়। বিকেলে স্কট মিস হলে পরের দিনের সকালের স্কটের জন্যই অপেক্ষা করতে হবে।
সাজেক এ কি কি দেখবেন
সাজেকের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে কংলাক পাড়া, রুইলুই পাড়া, হ্যালীপ্যাড, সূর্য ঘড়ি। কমলক ঝর্ণা, ষ্টোন গার্ডেন, শিব মন্দির, ঝাড়ভোজ। একদিনের ভ্রমনে আসলে এইসব জায়গা গুরা সম্ভব নয়। তাই এইগুলি সব ষ্পট দেখে শেষ করতে সাজেকে অন্তত ২রাত থাকতে হবে।
সাজেকে কি কি খাবেন
সাজেকে পর্যটকদের সবচাইতে প্রিয় খাবার হচ্ছে ব্যাম্বু চিকেন, ব্যাম্বু বিরিয়ানী, ব্যাম্বূ টি। এখন সাজেকে বেশ ভালো মানের অনেকগুলো রেস্তরা রয়েছে। আপনি আপনার পছন্দ মত যেকোন রেস্তোরায় খাবার সেরে নিতে পারবেন। সাজেকে ০৩ বেলা খুব ভালভাবে খেতে পারবেন মাত্র ৬০০-৭০০ টাকায়। সাজেকে ভালো রেষ্টরেন্ট গুলোর মধ্যে রয়েছে চিলেকোঠা, কাশবন, চিম্বাল, মারুতি ইত্যাদি।
কোথায় থাকবেন
সাজেকে পর্যটকদের থাকার জন্য বর্তমানে প্রায় শতাদিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। রিসোর্ট শতাদিক হলেও প্রতিটি হোটেলে এবং রিসোর্টে রুম সংখ্যা ২-৮ টি। কিছু কিছু রিসোর্ট রুম সংখ্যা ১০-১২ এর মধ্যে হবে তবে সেটা খুবই কম। তাই সাজেকে আসার আগে অবশ্যই হোটেল/ রিসোর্ট বুকিং দিয়ে আসবেন। সাজেকে বেশ কিছু ভালো মানের রিসোর্টের মধ্যে রয়েছে, সারা নীল কুটির, নীল পাহাড়ি ইকো রিসোর্ট, তরুছায়া ইকো রিসোর্ট, রিলাক্স ইকো রিসোর্ট, টং থক ইকো রিসোর্ট।
সাজেক-এ রিসোর্ট বুকিং এর জন্য এখনি যোগাযাগ করুন
নৌপথে সাজেক ভ্রমণে যে বিষয় গুলো অবশ্যই মনে রাখবেন
- কাপ্তাই লেকে বর্ষাকালে স্পিড বোট এড়িয়ে চলাই ভালো।
- সাজেক যাওয়া এবং আসার সময় চলন্ত গাড়ি থেকে স্থানীয় শিশুদের চকলেট, বিস্কুট, টাকা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারবেন না।
- আদিবাসীদের সাথে ছবি তোলার জন্য অবশ্যই অনুমতি নিয়ে নিবেন।
- আদিবাসীরা অনেক সহজ সরল তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করবেন।
- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা কিছু বললে সেটা মনযোগ সহকারে শুনবেন। কারণ উনারা যা বলবেন তা পর্যটকদের ভালোর জন্যই বলবেন।
- স্থানীয় আদিবাসীদের সংস্কৃতির প্রতি অসন্মান করবেন না।
- এসকর্টের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্পে চলে আসবেন।
- আর্মিদের এরিয়ায় ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ, তাই সকল ক্যান্টনমেন্ট এবং ক্যাম্পে ছবি তোলা থেক বিরত থাকুন।
- সাজেকের রাস্তা অনেক আঁকাবাঁকা ও অনেক উঁচু নিচু তাই ভ্রমণে গাড়ির ছাদে ভ্রমণ না করাই উওম।
- সাজেকে শুধুমাত্র রবি, এয়ারটেলের এবং টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, তাই ভ্রমণের সময় এইগূলোর যেকোন একটা সঙ্গে রাখুন।
- আসার আগে অবশ্যই হোটেল / রিসোর্ট বুকিং দিয়ে আসবেন।
- জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি সঙ্গে রাখবেন।
- ভ্রমণে গ্যাজেট সমূহ চার্জের জন্য পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে রাখুন।
- সাজেক ভ্যালীর সৌন্দর্য এবং পরিবেশ রক্ষায় আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকুন।